আমার সংগঠনে আসা

লেখক: এম এস চৌধুরী

আমার জীবনের বাতিঘর ছাত্রশিবির তখন আমি সদ্য চতুর্থ শ্রেণি শেষ করে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। এবারসহ টানা ৩ বছর ক্লাসের ফাস্ট বয়। তবু বাবা-মায়ের চাপ শুধু পড় আর পড়। কেন এত পড়তে হবে এর মানে বুঝতাম না। আমি অজপাড়া গাঁয়ে বড় হয়েছি। যেখানে তখন নিয়মিত দৈনিক পত্রিকাও পৌঁছাতো না। তাই দেশ বা দেশের মানুষের কথা ভাবাতো দূরের কথা কিছু জানতামই না। সবাই শুধু আমাকে বলতেন তোমাকে সেরা হতে হবে, কিন্তু কখনো শিক্ষকও বুঝাননি কেন আমাকে সেরা হতে হবে। আমি সেরা হলে কি হবো? রনি রোল এক হলেইবা সমস্যা কি? সত্যি কথা বলতে রোল এক খায় না মাথায় দেয় তাও শিখিনি। তখনো ছাত্রশিবির নামটি আমি শুনিনি।

একদিন দুপুরে বাজারের আমাদের দোকানে বসে পড়ছিলাম। আব্বু কাজের ফাঁকেই দোকানে বসিয়ে পড়াতেন। অল্প বয়সী একজন ভাইয়া কিছু একটা নিতে দোকানে আসলেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে কিছু কথা জানতে চাইলেন। জবাবে আমি ক্লাসের ফাস্ট বয় বলার পর আমাকে একটি বই উপহার দিলেন। বইটার নাম ছিল কিশোর কণ্ঠ। আমিও মহা খুশি হয়ে বাসায় এসে বইটা পুরোটুকু পড়লাম। একটা বইতে এত কিছু শিখলাম আর জানলাম যে আমি এর প্রেমে পড়ে গেলাম। বিশেষ করে "মোরা বড় হতে চাই" নামে একটি গল্প ছিল সেটা আমাকে স্বপ্ন দেখায়। পরদিন ওই ভাইকে আবার খুঁজে নেই। তার কাছ থেকে এমন বই আরো চাই। তিনি জানান যে এটা প্রতি মাসে বের হয়।

৫ টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়। সেই থেকে আমি কিশোর কণ্ঠের নিয়মিত পাঠক। কিশোর কণ্ঠের পাশাপাশি সেই ভাই আমাকে আরো বই দিতে থাকেন। বইগুলো পড়ে আমি বুঝতে পারি কেন আমাকে সেরা ছাত্র হতে হবে। কেন জানতে হবে সবকিছু? তার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়ে জানতে পারি, একটি সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়তে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে হবে। তাই আমাকে দক্ষ হতে বেশি বেশি পড়তে হবে, সৎ হতে ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল হতে হবে এবং দেশপ্রেমিক হতে হবে বলে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমরা সৎ ও দেশপ্রেমিক না হয়ে শুধু দক্ষ হলে অামাকে দিয়ে রাষ্ট্রের কোনো উপকারে আসবে না বরং ক্ষতি হবে।

আবার সৎ ও দেশপ্রেমিক হয়েও দক্ষতা না থাকলে দেশের জন্য অবদান রাখা সম্ভব নয়। তাই আমরা সবাই যদি মেধা, যোগ্যতা ও সততাকে সমন্বয় করে দেশের জন্য বিনিয়োগ করি তাহলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। সেই দিনের প্রোগ্রাম আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছিল তা আজো আমার জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করে যাচ্ছি অবিরাম। সেদিনের পর থেকে আমি শুধু প্রোগ্রামে যেতে চাইতাম। কারণ প্রোগ্রামে গেলেই আমার দেশপ্রেম বেড়ে উঠে। আমি শিক্ষার উদ্দেশ্য বুঝতে পারি এবং সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মিশনের একজন সফল কর্মী হতে পড়ালেখায় আরো মনোযোগি হই।

এরই মাধ্যমে আমার শিবিরে জড়িয়ে যাওয়া। ৬ষ্ট শ্রেণিতে উঠার পর দাদার স্বপ্ন পূরণ করতে বাবা আমাকে স্কুল থেকে এনে মাদ্রাসায় ভর্তি করলেন। মাদ্রাসায় এসে সৎ হওয়ার আরো উচ্চতর শিক্ষা পাবো বলে আমার ধারনা ছিল। কিন্তু আমি হতাশ হয়েছি যে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ফাজিল পাস করেও আমি ততটুকু অর্থবোধক শিক্ষা পাইনি যতটা আমাকে একদিনে শিবির দিয়েছে। হয়তো অনেকে ভাববেন আমি মাদ্রাসাকে ছোট করছি। বিশ্বাস করুন একটুও ছোট করছি না। আসলে আমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেছি, কুরআন-হাদীস শিখেছি এটা আমার অনেক বড় প্রাপ্য। তবে বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগের বিষয়ে খুব একটা নির্দেশনা পাইনি।

এটা আমার ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে যে গোটা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করা যায় ও করতে হয় সেটা সেভাবে পাইনি। শুধু মাদ্রাসা নয়, এরই মধ্যে দেশের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটও অর্জন করেছি। এখানে দেশপ্রেম শিখেছি, স্বাধীনতার চেতনা সম্পর্কে জেনেছি, সততার শিক্ষাও পেয়েছি। কিন্তু কখনো দক্ষতা, সততা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ের শিক্ষা পাইনি। যার ফলে আমাদে লাখ লাখ মেধাবী ও দক্ষ নাগরিক বের হচ্ছে কিন্তু সততা ও দেশপ্রেমের সমন্বয় না শেখায় কর্মস্থলে গিয়ে তারা দেশকে বিক্রি করতেও দিধা করছে না। দেশসেরা স্কুল, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে যা শিখেছি তার চেয়ে আমার কাছে শিবিরের সেদিনের প্রোগ্রামের শিক্ষাটা ছিল অত্যাধিক উত্তম।

কারণ আজ যখন কর্মস্থলে গিয়ে কোনো অন্যায় কাজের হাতছানি পাচ্ছি তখনি সেদিনের শিক্ষা আমাকে পথ আগলে ধরছে। বলছে, সততা আর দেশপ্রেম না থাকলে তোমার দক্ষতা দেশ ও দেশের মানুষের কোনো কাজে আসবে না। এর ফলে আমার কর্মস্থলে দূর্নীতির যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও আমি নিজেকে আজও তার সংস্পর্শে যেতে দিনি। তাইতো আজো স্যালুট করি সেদিনের ওয়ার্ড শিবির নেতা জাহিন ভাই আর সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে।